VTVUS

NEWS24/7

বাংলাদেশের রাজনীতিতে দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষা ও নেতাকর্মীদের আচরণ নিয়ন্ত্রণের প্রসঙ্গ বহু পুরনো। রাজনৈতিক দলগুলোর মুখে শাস্তির হুঁশিয়ারি শোনা গেলেও বাস্তবে কতটা কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। সম্প্রতি বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে একের পর এক অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়ানোর অভিযোগ নতুন করে আলোচনায় এসেছে।

দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষা একটি পুরনো আলোচনার বিষয় হলেও, বাস্তব চিত্র কি আসলেই শৃঙ্খলার প্রতিফলন ঘটায়? নাকি দলের ভাবমূর্তি রক্ষায় মাঝে মাঝে লোক দেখানো কিছু ব্যবস্থা নিয়েই থেমে যায় পুরো প্রক্রিয়া? সম্প্রতি বিএনপি ও এনসিপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ওঠা একের পর এক অভিযোগ নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে: দলীয় শাস্তি আসলে কতটা কার্যকর?

বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ দেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলোর প্রকাশ্য অবস্থান প্রায় একই- “প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে”। কখনো কখনো দলীয় বিবৃতি দিয়ে শোকজ বা বহিষ্কারের খবরও আসে সংবাদমাধ্যমে। কিন্তু সময় পেরিয়ে গেলে দেখা যায়, শাস্তিপ্রাপ্ত সেই ব্যক্তিরাই আবার কোনো না কোনোভাবে সক্রিয় হয়ে উঠছেন দলের কর্মকাণ্ডে। ফলে জনগণের মাঝে প্রশ্ন জাগে- এসব শাস্তি কি কেবল লোক দেখানো?


বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগের তালিকা ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে। সম্প্রতি পাটগ্রামে থানায় হামলা, ভোলায় ধর্ষণের অভিযোগ, খুলনায় পুলিশের ওপর হামলা- এই ঘটনাগুলোর সঙ্গে বিএনপির স্থানীয় পর্যায়ের নেতাকর্মীদের নাম উঠে এসেছে। প্রশ্ন উঠছে- দলটির কি মাঠপর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে?


বিশ্লেষকদের মতে, “সরকারবিরোধী আন্দোলনের উত্তেজনার সুযোগে কিছু নেতাকর্মী হয়তো ব্যক্তিস্বার্থে বা চাঁদাবাজি, দখল ইত্যাদিতে জড়িয়ে পড়ছে। এই আচরণ যদি দলীয়ভাবে প্রশ্রয় না-ও পায়, তবুও যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়া মানেই একটি নীরব স্বীকৃতি।”


বিতর্কিত মন্তব্য বা অনিয়মে এনসিপিসহ অন্যান্য উদীয়মান দলগুলোর নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধেও প্রশ্ন উঠেছে। জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর তাগিদে অনেক দলই নতুন ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ঠাঁই দিচ্ছে, কিন্তু তাদের অতীত বা আচরণ যথাযথ যাচাই না করেই। এতে দলীয় শৃঙ্খলার প্রশ্নটি আরও ঘোলাটে হয়ে উঠছে।


রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মাহবুবুল ইসলাম বাংলা আওয়ার কে বলেন, “বাংলাদেশের রাজনীতিতে দলীয় শাস্তির বিষয়টি এখন অনেকাংশেই প্রতীকী হয়ে উঠেছে। দলীয় শাস্তির কথা বলা হলেও কার্যত প্রভাবশালী বা জনসমর্থন থাকা নেতাদের বিরুদ্ধে খুব কম ক্ষেত্রেই চূড়ান্ত ব্যবস্থা নেয়া হয়। ফলে মাঠ পর্যায়ে নেতাকর্মীদের মাঝে বার্তা যায় ক্ষমতা থাকলে শাস্তি নেই।”


রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত হবে দলীয় গঠনতন্ত্রের প্রতি কঠোর আনুগত্য নিশ্চিত করা। শাস্তি ব্যবস্থাকে লোক দেখানো না রেখে স্বচ্ছ, গণমুখী ও ধারাবাহিক করার মাধ্যমে দলের ভিতরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

বিশ্লেষকদের মতে, দলের ভেতরে প্রকৃত শুদ্ধি আনতে হলে শুধুমাত্র শোকজ বা বহিষ্কার যথেষ্ট নয়। অপরাধ প্রমাণিত হলে দলের উচিত সদস্য পদ বাতিলসহ প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

এছাড়া, দলের ভেতরে স্বচ্ছ তদন্ত কমিটি, স্থানীয় পর্যায়ের নজরদারি এবং জনগণের সামনে অঙ্গীকারপূর্ণ অবস্থান নেয়া জরুরি। না হলে শৃঙ্খলার অভাব শুধু দলের ক্ষতি নয়, দেশের রাজনীতিকে আরও অস্থির ও অনির্ভরযোগ্য করে তুলবে।

দলীয় শৃঙ্খলা নিশ্চিত না হলে তা কেবল দলের নয়, পুরো দেশের রাজনীতিকেই অস্থির করে তোলে। ‘লোক দেখানো’ শাস্তির চর্চা রাজনীতিকে আরও অবিশ্বস্ত করে তোলে সাধারণ মানুষের কাছে। এখন সময় এসেছে, রাজনৈতিক দলগুলো শাস্তি ব্যবস্থাকে শুধুই বিবৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে কার্যকর প্রক্রিয়ায় রূপান্তর করে দেখাক—তাদের মধ্যে সত্যিকার শুদ্ধি আসছে।


বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব ঘটনা কেবল বিচ্ছিন্ন নয়, বরং এতে ফুটে উঠছে একটি গভীর রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক দুর্বলতা। প্রশ্ন উঠছে—দলীয় শাস্তি ব্যবস্থা আসলে কতটা কার্যকর? আদৌ কি এগুলো শাস্তি, নাকি লোক দেখানো পদক্ষেপ?


রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মাঠপর্যায়ে অনেকেই শুরুতে আন্দোলনের ক্ষোভ থেকে বা নিপীড়নের প্রতিক্রিয়ায় সহিংসতায় জড়ালেও, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা ‘অধিপত্য কায়েম’ বা ‘চাঁদাবাজি’র মতো অপরাধে রূপ নিচ্ছে।

তাদের মতে, “বিএনপি দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে, কিন্তু মাঠপর্যায়ে অনেক স্থানে দলীয় কর্মীরা এমনভাবে দখলদার ভূমিকায় আছেন, যেন তারা সরকারি দলেরই কেউ। এর পেছনে স্থানীয় প্রভাব, জোটবদ্ধ সংগঠন এবং প্রশাসনের নিরবতা ভূমিকা রাখছে।”

যেহেতু দলটি এখন ক্ষমতায় নেই, ফলে কর্মীদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সাংগঠনিক ব্যবস্থা অনেক ক্ষেত্রেই অকার্যকর থেকে যাচ্ছে। এ সুযোগেই কিছু ব্যক্তি ব্যক্তি স্বার্থে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে বলে মত বিশ্লেষকদের।


রাজনীতিতে শৃঙ্খলা বজায় রাখা শুধু দলের ভাবমূর্তি নয়, দেশের গণতন্ত্র রক্ষার জন্যও জরুরি। দলীয় শাস্তির নামে লোক দেখানো ব্যবস্থা, মাঠপর্যায়ে অপরাধীদের প্রশ্রয়, আর অপরাধের পর ‘চুপচাপ ফিরে আসা’ এই সংস্কৃতি চলতে থাকলে জনগণের আস্থা হারাবে সব রাজনৈতিক দলই।

Categories:

Tagged:

Comments are closed